Saturday, 7 October 2023

ক্যারিয়ার ভাবনা

ক্যারিয়ার ভাবনা



 বাংলাদেশে সমকালীন প্রেক্ষাপটে তরুণদের ক্যারিয়ার ভাবনা একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ক্যারিয়ার বলতে জীবিকা অর্জনের উপায় বা বৃত্তি, জীবনায়ন ইত্যাদিকে বুঝায়। সুশিক্ষার মাধ্যমে অর্জিত একটি নিশ্চিত ক্যারিয়ারই দিতে পারে ব্যক্তির জীবন যাপনে পর্যাপ্ত আর্থিক নিশ্চয়তা, সামাজিক মর্যাদা, সুস্থ-স্বাভাবিক জীবন। শিক্ষাজীবনের শুরু থেকেই তাই নির্দিষ্ট লক্ষ্য নির্ধারণ না করলে ভবিষ্যতে সম্মুখীন হতে হয় নানামুখী বিপত্তির। ক্যারিয়ার বাছাইয়ে কেউ অর্থ, কেউবা স্বপ্নকে প্রাধান্য দেন। কিন্তু শুধু অর্থ বা শুধু স্বপ্নকে নয়, প্রাধান্য দিতে হবে উভয়কেই। সুখী ও সমৃদ্ধ জীবনের নিশ্চয়তার জন্য ক্যারিয়ার নিয়ে ভাবতে হবে শুরু থেকেই।

সবারই স্বপ্ন থাকে লেখাপড়া শেষে ভালো একটি চাকরি ও চমৎকার একটি কর্মক্ষেত্রের। স্বপ্নের চাকরি পেতে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অনেকে পড়াশোনাও করে থাকেন। তবে কিছু ভাবনাগত অভাবের ফলে স্বপ্নকে ধরতে পারে না। অভাবগুলো এতটাই তীব্র হয় যে, পুরোদমে বিকল করে দেয় ভেতরে পুষে রাখা লালিত স্বপ্নের চাকরির আকাঙ্খা। অনাকাঙ্খাক্ষিত এসব অভাব জয় করেই আমাদের স্বপ্নের লক্ষ্যে পৌঁছাতে হবে। ভালো ক্যারিয়ার গড়তে হলে অনেক বিষয়ই বিবেচ্য। মানুষের ক্যারিয়ার গড়ার কারিগর সে নিজেই।

বর্তমান সময়ে সচেতন বাবা-মাও সন্তানের ক্যারিয়ারের দিকে মনোনিবেশ করে থাকেন। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অভিভাবকরা নিজেদের স্বপ্নকে সন্তানের ক্যারিয়ারের ওপর এমনভাবে চাপিয়ে দেন যে, তা সন্তানের জন্য হয়ে ওঠে সাফল্যের বড় অন্তরায়। বলা বাহুল্য, শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার পরপরই ঐ শিশুর বাবা-মা তার ক্যারিয়ার নিয়ে রীতিমতো অশ্বমেধ যজ্ঞ করেন আঠারো আনা অধিকার নিয়ে! সন্তানরাও নিজেদের বাধ্য ও সুসন্তান হিসেবে পরিচিত করতে অগাকান্তের মতো তাদের স্বপ্নপূরণে ব্রতী হয়ে ওঠে। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, সন্তানরা কী হতে চায়, তাদের সাধ্য কতটুকুএসবের তোয়াক্কা করা হয় না। সন্তানরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই পিতা-মাতার স্বপ্নকে নিজের স্বপ্ন হিসেবে লালন করে সাধ্যের বাইরে গিয়ে। কী অদ্ভুত কথা! 

অস্বীকার করার উপায় নেই, কাঙ্ক্ষিত ফলাফল করতে না পারলে সন্তানদের সহ্য করতে হয় পিতা-মাতার তাচ্ছিল্যসূচক বাক্য, অন্যের সঙ্গে তুলনা, যা তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। সন্তানের ‘ভালো’ ক্যারিয়ারের জন্য তারা যে অতিরিক্ত চাপ প্রয়োগ করেন, তা সন্তানের জন্য বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ার কারণ। মনে রাখতে হবে, জীবনের আসল উদ্দেশ্য ক্যারিয়ারের  পেছনে দৌড়ানো নয়, বরং যাবিত জীবনকে আনন্দের সঙ্গে উপভোগ করা। ক্যারিয়ারে সফল হতে বা সফল ক্যারিয়ার বেছে নেওয়ার এই রিলে রেইসে আমরা যেন ভুলেই যাইআর্ট ইজ লং, লাইফ ইজ শর্ট তথা বিদ্যা অনন্ত, জীবন সংক্ষিপ্ত। ভাবুন তো একবারএই সংক্ষিপ্ত জীবনে আমরা শিক্ষার উদ্দেশ্য কতটুকু প্রয়োগ করতে পারি? ক্যারিয়ার নির্বাচনের প্রেক্ষাপটেও বলা যায়, শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য কেবল সার্টিফিকেট অর্জন নয়, বরং ব্যক্তির অন্তর্নিহিত গুণাবলির পূর্ণ বিকাশ ঘটিয়ে মানুষকে সত্যিকারের মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা। চাকরি পাওয়া বা না পাওয়ার সঙ্গে এটি সম্পর্কিত, তবে মুখ্য বিষয় নয়। বিষয়টি আমরা বুঝতে পারি না বলেই দেশে এতো শিক্ষিত ও উচ্চশিক্ষিত বেকার। 

ছোট থেকে নির্বাচন করা কিছু কমন ক্যারিয়ার বেছে নিয়ে হুমড়ি খেয়ে সেই গড্ডালিকা প্রবাহ অনুসরণ করে চলি আমরা সবাই। ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার বা ক্যাডার সার্ভিস ছাড়া যে আরো অনেক ক্ষেত্রে ক্যারিয়ার গড়া সম্ভব, তা যেন আমরা মানতে নারাজ! ক্যারিয়ারের দৌড়ে যারা সফল হয়, তারা যেন অমাবস্যার চাঁদ পায়। কিন্তু যারা ব্যর্থ হয়, তারা হতাশার সাগরে নিমজ্জিত হয়এমনটি কেন হবে! এই অবস্থায় ক্যারিয়ার নিয়ে প্রথাগত ভাবনা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে সর্বাগ্রে। ভুলে গেলে চলবে না, স্বাবলম্বন সর্বশ্রেষ্ঠ অবলম্বন। নিজে চাকরির জন্য না ছুটে বরং উদ্যোক্তা হয়ে চাকরি প্রার্থীদের কর্মক্ষেত্রের সুযোগ করে দেওয়ার মতো যোগ্যতা ও মানসিকতা গড়ে তুলতে হবে। আমাদের মাথায় রাখতে হবে যে, কোনো পেশাই ছোট নয়। কোনো পেশাকেই ছোট করে না দেখার মানসিকতা ক্যারিয়ার ভাবনায় বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে পারে নিঃসন্দেহে। সত্যিকার অর্থে একটি সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য মানুষের চলার পথ ও গতিকে কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিতে পারে।

শিখতে হবে যে কোনো পরিস্থিতিতে:

প্রতিনিয়ত পৃথিবীর পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে নতুন নতুন পদ্ধতিও বের হচ্ছে। যদি মনে হয় আপনার দক্ষতা অনুযায়ী বর্তমান চাকরি অনেক ভালো, তারপরও আপনাকে বর্তমান অবস্থানে থেকে সবকিছু ভালোভাবে শিখে নিতে হবে। যদি ভবিষ্যতে এর চেয়েও ভালো কিছু করতে চান সেক্ষেত্রে আপনার পূর্ব-দক্ষতা এবং জ্ঞান কাজে লাগবে।

শুনুন, প্রশ্ন করুন এবং শিখুন: কথায় আছে একজন ভালো শ্রোতা অনেক কিছু শিখতে পারে। তাই আপনার সহকর্মী ও সিনিয়র যা বলেন, তা শুনুন। তাদের অভিজ্ঞতা এবং উপদেশ থেকে আপনি অনেক কিছু শিখতে পারবেন। আপনার কাজ সম্পর্কিত যে যে বিষয়ে সমস্যা অনুধাবন করবেন, সে সম্পর্কে তাদের জিজ্ঞেস করে সমাধান জেনে নিন।

বর্তমান কাজকে মূল্যায়ন করতে শিখুন: ক্যারিয়ার শুরুর সবচেয়ে ভালো মাধ্যম হচ্ছে আপনার বর্তমান কাজ। কোনো কিছুই বিনাশ্রমে আসে না, যারা এটা মানে তারাই সফলকাম হয়। আপনি যদি আপনার বর্তমান কাজের সব দায়-দায়িত্ব আস্থার সঙ্গে পালন করেন, তাহলে এটাই হতে পারে আপনার নতুন বা ভবিষ্যৎ ক্যারিয়ার গড়ার সিঁড়ি। যখন যে কাজ আপনার ওপর অর্পিত হবে তা নির্দ্বিধায় করুন। কাজের মাধ্যমেই পারেন আপনি আপনার বসের তথা প্রতিষ্ঠানের আস্থা অর্জন করতে। তাহলে ভবিষ্যতে আপনার প্রতিষ্ঠানের কোনো গুরুত্বপূর্ণ পদ সৃষ্টি হলে, সেই পদের জন্য যোগ্যতার নিমিত্ত আপনাকে অগ্রাধিকার দেয়া হবে।

সম্পর্ক গড়ে তুলুন: ক্যারিয়ারের পরবর্তী ধাপ অনেকটা আপনার যোগাযোগের সামর্থ্যের ওপর নির্ভর করে। শতকরা ৫০%-এরও বেশি চাকরি হয় জানা শোনা ও সম্পর্কের মাধ্যমে। আপনার সম্পর্কের জাল যদি বিস্তৃত হয়, তবে সেখান থেকে আপনি নতুন নতুন সুযোগ ও বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা সংবলিত ধারণা পাবেন যা আপনার ক্যারিয়ারে নতুন দ্বার উন্মোচন করতে পারে। তাই নতুন সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে এবং তাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতে হবে।

কাজকে গ্রহণ করুন: বর্তমান কাজকে সাদরে গ্রহণ করতে শিখুন। নিশ্চিত হোন, আপনি আপনার কাজকে গ্রহণ করেছেন নাকি বাধ্য হয়ে মেনে নিয়েছেন। যদি শেষেরটি হয় তবে আপনার সময় এবং মেধা দুটোরই অপচয় হবে। যখন একটি নতুন চাকরি শুরু করবেন, তখন আপনার কাজ, কাজের মূল্যায়ন এবং এর ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা নিয়ে আপনার সহকর্মী কিংবা ঊর্ধ্বতন কারও সঙ্গে আলাপ করে নিতে পারেন। এক্ষেত্রে আপনার ভেতরের চিন্তা-চেতনার পরিবর্তন হতেও পারে।

নিজেকে প্রস্তুত করুন: এক মুহূর্তও অপচয় নয়। আপনার জীবন বৃত্তান্ত এখন থেকে প্রতিনিয়ত আপডেট করুন। কালকেই হয়তোবা আপনার হাতের কাছে ধরা দিতে পারে স্বপ্নের চাকরি। যদি আপনি না জানেন কীভাবে সিভি লিখে এবং কীভাবে নিজেকে উপস্থাপন করতে হয় তবে এখন থেকেই তা শিখতে চেষ্টা করুন।

সময় সচেতনতা: প্রত্যেকটা মানুষেরই উচিত সময়ের সঠিক ব্যবহার করা। সময়ের কাজ সময়ে করতে পারলে যে কোনো ব্যক্তিই তার ক্যারিয়ারকে সফল স্থানে নিয়ে যেতে পারবে। অযথা সময় অপচয়কারী প্রয়োজনীয় সময় এসে হাঁপিয়ে ওঠে। ফলে সে তার কাজে ভুল করে। পরে করব বলে ফেলে রাখলে কোনো কাজেরই সফল সমাধান দেয়া সম্ভব নয়। তাই সময় সচেতন হয়ে উঠুন।

 

তাই জীবনকে সুন্দরভাবে উপভোগের মধ্য দিয়েই ক্যারিয়ার নিয়ে ভাবতে হবে। বাস্তবমুখী হয়ে ক্যারিয়ার নির্বাচন করতে পারলেই সার্বিক উন্নয়নে এগিয়ে যাব আমরাএগিয়ে যাবে দেশ।

 প্রতিবেদনটি লিখেছেন:

লেখকগবেষক ও স্কাউটারমোহাম্মদ সাইফুদ্দিন

শিক্ষকবায়তুশ শরফ আদর্শ কামিল (অনার্সমাস্টার্স) মাদরাসা

মোবাইলঃ ০১৮১৯৯৪৭৩৮৭,

ই-মেইলঃsaifuddinbaitushsharaf@gmail.com