Header Ads

ডায়েরি লিখুন রোজ

ডায়েরি লিখুন রোজ

দিনলিপি’ হলো জীবনের ঘটনাবহুল দিনগুলোর প্রামাণ্য দলিল। এর ইংরেজি প্রতিশব্দ 'Dairy'ব্যক্তির দৈনন্দিন জীবনযাত্রার ঘটনাক্রমের সুলিখিত রূপকে বলা হয় দিনলিপি। এর আরেকটি প্রতিশব্দ হলো ‘রোজনামচা’, তবে ‘দিনলিপি’ শব্দটিই বহুল পরিচিত। পলায়নপর সময়কে ধরে রাখা এবং ঘটনাবহুল বর্তমানকে ভবিষ্যৎকালের করে তোলার প্রয়াসই মানুষকে দিনলিপি লেখার অনুপ্রেরণা জোগায়।

দিনলিপি ব্যক্তির একান্ত ব্যক্তিগত বিষয় হলেও সুলিখিত দিনলিপি শিল্পগুণসম্পন্ন সাহিত্য হয়ে ওঠে। উল্লেখযোগ্য শিল্পগুণসমৃদ্ধ দিনলিপির কয়েকটি দৃষ্টান্ত হলোরবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘জাপান-যাত্রী’, জাহানারা ইমামের ‘একাত্তরের দিনগুলি’, সুফিয়া কামালের ‘একাত্তরের ডায়েরি’, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের স্মৃতিবাহী ‘আনা ফ্রাঙ্কের ডায়েরি’ ইত্যাদি।

দিনলিপি লিখন অত্যন্ত সুন্দর একটি অভ্যাস। এর মধ্য দিয়ে ব্যক্তির সৃজনশীল প্রতিভার বিকাশ ঘটে। সারা দিনের কাজকর্মের ধারাবাহিক উপস্থাপন দিনলিপি লেখকের শিল্প-প্রতিভার বিকাশ ঘটায়। সর্বোপরি, সুলিখিত দিনলিপি একটি অমূল্য ব্যক্তিগত সম্পদে পরিণত হয়।

দিনলিপি লিখনের ক্ষেত্রে যেসব বিষয় মনে রাখা দরকার তা হলো:দিনলিপি বা ডায়েরি রচনার জন্য সেদিনের তারিখ, বার, লেখার সময় ও স্থান উল্লেখ করতে হয়। দিনলিপি রচনার জন্য প্রদত্ত-ব্যক্তি পরিচয়/অবস্থাকে ভিত্তি করে সারা দিনের ঘটনাপ্রবাহ থেকে উল্লেখযোগ্য ঘটনা বা ঘটনাবলি বেছে নিতে হয়। দিনলিপি বর্ণনায় রচয়িতার প্রত্যক্ষ উপস্থিতি থাকে, অর্থাৎ দিনলিপি সব সময় উত্তম পুরুষে (আমি, আমরা) লিখতে হয়। দিনলিপিতে সাধারণত একটি দিনের ঘটনাবলির বর্ণনা থাকলেও অতীতের ঘটনা প্রসঙ্গক্রমে আসতে পারে। একান্ত ব্যক্তিগত কথা বা ঘটনাবলি নিয়ে দিনলিপি রচিত হয় বলে এর শুরু ও শেষ লেখকের নিজস্ব রুচিবোধ ও তাৎক্ষণিক অনুভূতি বা ধ্যানধারণার ওপর নির্ভর করে। দিনলিপি প্রমিত রীতিতে সহজ, সরল ও প্রাঞ্জল ভাষায় লেখা বাঞ্ছনীয়। দিনলিপি লিখনে ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত চরিত্রগুলোর পরিচয় সংক্ষেপে দিতে হয়। দিনলিপিতে রচয়িতার নিজস্ব বিশ্লেষণ, ব্যক্তিগত মতামত থাকতে পারে। দিনলিপি কতটুকু লিখতে হবে, তা নির্ভর করে নির্বাচিত বিষয়ের ওপর। দিনলিপি এক প্যারায় লেখা ভালো, তবে প্রয়োজনে একাধিক প্যারা করা যাবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের সাধারণত স্কুল বা কলেজজীবনের প্রথম দিনের অনুভূতি বা অভিজ্ঞতা ব্যক্ত করার মাধ্যমে দিনলিপি লিখনের হাতেখড়ি দেওয়া হয়। এরপর ধীরে ধীরে বিভিন্ন অনুভূতির কথা, যেমন পরীক্ষার ফল প্রকাশ, কোনো ঐতিহাসিক স্থান দর্শন, মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনা, লঞ্চডুবি, যানজট, মেলা দেখা, জাতীয় দিবস উদ্‌যাপন, পয়লা বৈশাখ/নববর্ষ উদ্‌যাপন, বর্ষণমুখর দিন বা ঝড়ের দিন ইত্যাদি বিষয়ের ওপর দিনলিপি লিখনের কথা বলা হয়। দিনলিপি ব্যক্তিগত হৃদয়ানুভূতিরই প্রকাশ। ব্যক্তি তার সারা দিনের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনার বিশেষ অনুভূতিগুলোকে ধরে রাখতে চায় তার লেখনীতে। তাই দিনলিপির বিষয় যা-ই হোক না কেন, উপর্যুক্ত লিখন-কৌশল মনে রাখলে একটি দিনলিপি প্রাঞ্জল, অসাধারণ ও হৃদয়গ্রাহী হয়ে ওঠে।

 ভুলগুলোকে জানাঃ আজকে যে কাজটা ঠিক ভেবে করে ফেললেন, সেই কাজটাই কালকে আপনার জন্য ভুল হয়ে দেখা দিলো কিনা, সেটা ভেবে দেখবার উপযুক্ত সুযোগ দেবে ডায়েরি লেখার অভ্যাসে। আপনার ডায়েরি পড়ে পরবর্তীতে আপনি নিজেই নিজেকে চিনতে পারবেন, বুঝতে পারবেন আপনি ইতিবাচকভাবে বদলেছেন নাকি নেতিবাচকভাবে।

স্মৃতিগুলো ধরে রাখুনঃ আজকে থেকে কয়েক বছর পর, যে জিনিসটা আসলেই কাজে আসবে তা হলো আপনার অভিজ্ঞতা। ফেসবুকে পিকনিকের ছবি আপলোড করে হয়তো লাইক পাওয়া যাবে, কিন্তু পিকনিকে কী কী হলো, কার জামা ছিঁড়ে গিয়েছিলো, কে চালাকি করে দুইবার খাবার নিয়েছিলো, এগুলো লিখে রাখলে কোনো একদিন এগুলোই আপনার মুখে জেনুইন হাসি এনে দেবে। আপনার সেই কলেজ বাংক করে বন্ধুদের সাথে মুভি দেখতে যাবার যে সিক্রেটটা বাসায় কেউ জানেনা, সেটা ডায়েরিকে জানিয়ে রাখুন। কে জানে হয়তো কোনোদিন আপনার মিনি ভার্সনরা ডায়েরিটা পড়ে বুঝতে পারবে, আপনিও তাদের মতই ছিলেন!

লিখতে লিখতে লেখক লেখালেখির শখ থাকলে বা লেখার দক্ষতা বাড়াতে চাইলে ডায়েরি লেখা খুবই কার্যকর। বাংলা ইংরেজী যে ভাষায় ইচ্ছা লিখতে পারেন। প্রতিদিন লেখা না হলেও সপ্তাহে ৩-৪ বার লেখার অভ্যাস করতে পারেন। আপনার জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো ব্যাখ্যা করে লেখার সময় আপনার নিজের দৃষ্টিকোণটা নিজে বুঝতে পারবেন।

ডায়েরি লেখার অ্যাপ ডায়েরী যে কাগজ কলমেই লিখতে হবে এমন কোনো কথা নেই। এখন অনেক রকম অ্যাপ বের হয়েছে, যেগুলো ট্রাই করে দেখতে পারেন। এমন কিছু অ্যাপ হচ্ছে –“Penzu”, “Diaro”, “Journey- Diary, Journal”, “Daylio” ইত্যাদি। এসব অ্যাপের ইউজার ইন্টারফেস আপনার স্বাচ্ছন্দ্যে ডায়েরি লেখার জন্য খুবই কাজে দেবে। এখানে লেখার পাশাপাশি ছবি এটাচ করা, ম্যাপে আপনার অবস্থান এটাচ করা, ক্যালেন্ডার মার্কিং করা ইত্যাদি অপশন রয়েছে। পাসকোড দিয়ে আপনার ডায়েরি এনক্রিপ্টেড করে রাখতে পারবেন। কিছু অ্যাপ আছে যেখানে আপনার কিছু লিখতে হবেনা, আপনি আপনার মুড আর সারাদিনের হাজারো একটিভিটি থেকে আপনার একটিভিটি সিলেক্ট করে ডায়েরী এন্ট্রি সেভ করতে পারবেন। মাসের শেষে অ্যাপ আপনাকে মান্থলি মুড চার্টও দেখাবে!

টু ডু লিস্টঃ আগামীকাল কী কী করণীয় তা খুব সহজেই লিখে রাখা যায় ডায়েরির পাতায়৷ ফলে কোনও বিশেষ কাজ মনে রাখতে সুবিধা হয়৷ ফলে ডায়েরি লেখা সবসময়ই ভালো অপশন৷

বিশেষ মুহূর্তঃ কলেজের শেষ দিন হোক বা বিয়ের দিন ক্লিক ফিভারে সকলে জর্জরিত! কেন? শুধুমাত্র স্মৃতি উল্টে দেখার জন্য৷ সেক্ষেত্রে কোনও বিশেষ মুহূর্ত লিখে রাখলে ভবিষ্যতে তা মনে করে স্মৃতি রোমন্থন করা যায় খুব সহজেই৷ আর এটা তো স্মৃতি মনে করার সবচেয়ে উপায়৷

রাইটিং স্কিলঃ অভ্যাস করেই অভ্যাস হয়৷ তাই ছোট থেকে ডায়েরি লেখার অভ্যাস থাকলে আস্তে আস্তে লেখনী মজবুত হয়৷ বাংলা হোক বা ইংরেজি, লিখতে জানলে সারাজীবনই সুবিধা পাওয়া যায়৷ ছাত্রছাত্রীদের যে সুবিধা হয়ই তা বলা বাহুল্য৷

ভুলঃ জীবনে ফিরে দেখার সবচেয়ে ভালো উপায় ডায়েরি৷ সেক্ষেত্রে কী কী ভুল হয়েছে সেটা ডায়েরি দেখে বোঝা যায়৷ আর যখন আবার সেই ধরনের কোনও মুহূর্তের চৌকাঠে আপনি দাঁড়াবেন তখন কীভাবে রিয়াক্ট করলে অন্তত ভুল হবে না সেটা ফিরে দেখতে পারবেন সহজেই৷

সাফল্যঃ যে কোনও মানুষই নিজের সাফল্য দেখে আনন্দ পায়৷ প্রথম হাউসক্যাপ্টেন হওয়া হোক কিংবা মাধ্যমিকে স্টার পাওয়া বা প্রথম চাকরী পাওয়া যে কোনও সাফল্যই পাতা উল্টে পড়তে বেশ লাগে৷ তাছাড়া কোনও দুঃখের মুহূর্তে পুরানো সাফল্য মনে অনেকটা পজিটিভিটি আনে৷ তাই ডায়েরি লেখা অবশ্যই ভালো অভ্যাস৷

বেস্ট ফ্রেন্ডঃ যে কথাটা আপনি আপনার সবচেয়ে কাছের বন্ধুটিকে বলতেও দ্বিধা করছেন সেই কথাও খুব সহজেই ডায়েরিতে লিখে রাখা যায়৷ যে কোনও সিক্রেট খুব সহজেই শেয়ার করা যায় ডায়েরির সঙ্গে৷ কারন এক্ষেত্রে গোপন কথাটি একেবারে গোপনে৷ তাই ডায়েরি নিঃসন্দেহে আপনার প্রিয় বন্ধু৷

থেরাপিঃ যে কোনও খারাপ মুহূর্ত ডায়েরির পাতায় লিখলে মন অনেক হালকা লাগে৷ তাছাড়া খারাপ লাগার কথা লিখে ফেললে মন খারাপের পরিমাণটাও অনেকটা কমে৷ এমনকি সুদিনেও কফি হাতে আধ ঘণ্টা ডায়েরির সঙ্গে কাটালে ভালো ফিলিংস হয়৷ এটা একরকমের মন ভালো রাখার থেরাপিও বলতে পারেন৷

প্রতিদিন ডায়েরি লেখা আপনার সৃজনশীলতাকে শাণিত করবে। আর সেগুলো থেকে নির্বাচিত লেখা প্রকাশ করে পত্রিকা তৈরি করলে আপনার কাজ বৃহত্তর পাঠকের কাছে পৌঁছে যাবে।

প্রতিবেদনটি লিখেছেন:
লেখক, গবেষক ও স্কাউটারমোহাম্মদ সাইফুদ্দিন

শিক্ষকবায়তুশ শরফ আদর্শ কামিল (অনার্সমাস্টার্স) মাদরাসা

মোবাইলঃ ০১৮১৯৯৪৭৩৮৭,

ই-মেইলঃsaifuddinbaitushsharaf@gmail.com

 


No comments

Powered by Blogger.