পড়ালেখায় মনোযোগী হবার সহজ উপায়
পড়ালেখায় মনোযোগী
হবার সহজ উপায়
বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয় শিক্ষার্থীদের। পড়ালেখায় মনোযোগ ধরে রাখা সবসময় সহজ
নয়, বিশেষ
করে যখন অনেক কিছু শিখতে হয় এবং পরীক্ষার চাপ থাকে। শিক্ষাজীবনে
আমাদের অনেক কিছু মনে রাখতে হয়। কারণ পরীক্ষায় ভালো ফলাফলের জন্য চাই বেশি তথ্য
মনে রাখা। যে যত বেশি তথ্য পরীক্ষার খাতায় উপস্থাপন করতে পারবে,
সে তত বেশি ভালো ফলাফল করতে পারবে। কীভাবে আমরা লেখাপড়ায় মনোযোগ
দিতে পারব এবার তা নিয়ে একটু অলোকপাত করা যাক।
শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম বা মেডিটেশন
মনোযোগ বাড়ানোর জন্য আগে নিজেকে শান্ত ও স্থির রাখতে হবে।
এজন্য শ্বাস প্রশ্বাসের ব্যায়াম খুব উপকারী। সকালে মেরুদণ্ড সোজা করে বসে লম্বা
করে নাকে শ্বাস নিন, কিছুক্ষণ অপেক্ষা করুন এবং মুখ দিয়ে নিশ্বাস ছাড়ুন। এভাবে কয়েকবার
করুন। তারপর কিছু সময় চোখ বন্ধ করে ভাবুন আপনার এখন মনোযোগ আসবে। সকালে বা দিনের
কোনো নিদিষ্ট সময় মেডিটেশনের জন্য বরাদ্দ রাখা উচিত।
বিশেষজ্ঞরা মনোযোগ বাড়ানোর জন্য শুরুতেই সহজ কিছু করার পরামর্শ
দেন। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি উপযোগী হচ্ছে `পোমোডোরো' মেথড। এই
মেথডের মূল কথা হচ্ছে, ২৫ মিনিট এক নাগাড়ে কাজ করে ৫ মিনিটের বিরতি নেওয়া। এভাবে ২৫ মিনিট
করে তিনবার কাজ করার পর ২০ মিনিট বিরতি নেওয়া।
মোবাইল ফোন, টেলিভিশনের মতো
কিছু ডিভাইস কাজে মনোযোগ আনতে সবচেয়ে বেশি বাধা দেয়। জার্নাল অফ বিহেভিয়ারাল অ্যাডিকশনের
সাম্প্রতিক একটি স্টাডিতে প্রকাশিত হয়েছে, আপনি যখন কোনো কাজ করেন, ওই মুহূর্তে
কাজ করার পাশাপাশি যদি ইলেকট্রনিক ডিভাইস বা ফোন ব্যবহার করে থাকেন তবে আপনার
কাজের প্রতি মনোযোগ অনেকটাই কমে যায়। তাই গুরুত্বপূর্ণ কাজ শুরু করার আগে
ব্যক্তিগত ফোনটি কিছু সময়ের জন্য দূরে রাখাই শ্রেয়।
কাজের তালিকা করুন
যে কোনো কাজে মনোযোগ থাকলে সময় কম লাগে। এজন্য গুরুত্ব অনুযায়ী
তালিকাবদ্ধ করে নিন আপনার কাজের বিষয়গুলো। কাজ জমিয়ে না রেখে একে একে সেরে ফেলুন।
একসঙ্গে অনেক কাজ জমিয়ে রাখলে মস্তিষ্ক অস্থির হয়ে পড়ে। যে কারণে একটিতে মনোযোগ
দেওয়া সম্ভব হয় না। কবে কী কাজ, সেই তালিকা বা চেকলিস্ট তৈরি করে নেওয়া যেতে পারে। গুগল
ক্যালেন্ডার বা মোবাইলে 'টু ডু লিস্ট' না করে ডায়রিতে টুকে ফেলুন।
কোনো
কাজ যদি সঠিক সময়ে শুরু করতে চান আর সেখান থেকে সফলতার মুখ দেখতে চান তবে কাজে
লাগান নিজে ইচ্ছাশক্তিকে। নিজেকে কথা দিন এই কাজটি শেষ করার আগে উঠছেন না আপনি। 'আমি পারি, আমাকে এই কাজটা
নিখুঁতভাবে শেষ করতে হবে' এই বিষয়টা মনে গেঁথে নিন। তাই বলে সারাদিন দরজা বন্ধ করে কাজে
ডুবে থাকবেন না, তাহলে কিন্তু ইচ্ছাশক্তি দৌড়ে পালাবে!
যেকোনো কাজ খুব মনোযোগ দিয়ে করুন। খাওয়ার সময় খাবারের রং, স্বাদ সবকিছু
পর্যবেক্ষণ করুন। মুভি দেখার সময় নায়ক হাত কীভাবে নাড়াচ্ছেন, কথা বলার সময়
চোয়াল কীভাবে নাড়াচ্ছেন, সব খেয়াল করুন। ঠিক তেমনি কেউ কথা বলার সময় কী বলছেন, কীভাবে কথা
বলছেন তা মন দিয়ে শুনুন। শ্রবণ শক্তিকে সমৃদ্ধ করুন। মনোযোগ একটি চর্চার বিষয়। যত বেশি মনোযোগ
দিয়ে আপনি আপনার প্রাত্যহিক কাজ করবেন তত বেশি মনোযোগের চর্চার
মধ্যে থাকবেন।
হ্যাঁ ঠিকই পড়েছেন।
শারীরিকভাবে সুস্থ থাকার জন্য যেমন শারীরিক ব্যায়াম প্রয়োজন, তেমনি
মানসিকভাবে সুস্থ থাকার জন্য প্রয়োজন মানসিক ব্যায়াম বা মস্তিষ্কের ব্যায়াম। গুগলে
খুঁজলে আপনি অসংখ্য গেমস পাবেন যা তৈরিই হয়েছে আপনার মনোযোগ বৃদ্ধি করার উদ্দেশ্য
নিয়ে। ব্রেইন ট্রেইনিং গেমগুলো আপনাকে দ্রুত ভাবতে, সিদ্ধান্ত নিতে
কিংবা আপনার স্মরণশক্তি বাড়াতে সাহায্য করবে। প্রতি সপ্তাহে অন্তত একটা করে খেলুন।
তবে গেম খেলতে গিয়ে শরীরে যাতে জড়তা চলে না আসে, সেদিকেও খেয়াল
রাখুন।
খেয়াল রাখুন ঘুমে
মনোযোগ স্থির রাখার জন্য প্রয়োজন ঘুম। ঘুম কম হলে আমাদের
মনোযোগে যেমন বাধা সৃষ্টি হয়, তেমনি অতিরিক্ত ঘুম ব্রেনকে স্থবির করে দেয়। একজন পূর্ণ বয়স্ক
মানুষের দৈনন্দিন ৬ থেকে ৮ ঘণ্টা ঘুমের প্রয়োজন হয়।
উদ্ভিজ্জ খাবার, সবুজ শাকসবজি ফলমূল গ্রহণে উৎসাহী
হোন। রেডমিট, পরিশোধিত শর্করা, অতিরিক্ত চর্বি জাতীয় খাবার
খাদ্যতালিকা থেকে কমানোর চেষ্টা করুন। আমিষ বেছে নিন এমনভাবে, যাতে ক্যালরি ও
খারাপ চর্বির পরিমাণ থাকে কম। খাবারে লবণের ব্যবহার করতে হবে সীমিত। পাতে বাড়তি
লবণ বর্জনীয়। ওমেগা–৩ যুক্ত খাবার যেমন বাদাম, সামুদ্রিক মাছ মনোযোগ বাড়ায়। কখনোই
খালি পেটে কাজ করতে বসবেন না, এতে মনোযোগ ধরে রাখা বেশ কঠিন। কাজ শুরুর আগে হালকা স্ন্যাকস
জাতীয় খাবার খেয়ে নিতে পারেন। তবে পেট ভরে যাবেন না, এতে মনোযোগের
বদলে চোখ জুড়ে আসবে ঘুম।
শরীরচর্চা বা ব্যায়াম করলে আমাদের মস্তিষ্কের উন্নতি ঘটে।
গবেষণায় দেখা গেছে, একই রকম মেধাসম্পন্ন হওয়া সত্ত্বেও সারাদিন শুয়ে বসে কাটানো
শিক্ষার্থীদের তুলনায় যারা শারীরিক পরিশ্রম করেন, তাদের পরীক্ষায়
ফলাফল ভালো হয়। মস্তিষ্কে
আরও বেশি যোগাযোগ স্থাপিত হয়।
বিরতি
নিয়ে পড়ুন
একটানা পড়লে
মনোযোগ ধরে রাখতে কষ্ট হয়। কিছুক্ষণ পরপর বিরতি নিলে মস্তিষ্কের ধারণক্ষমতা বাড়ে
এবং পড়া মনে থাকে। তাই ২৫ মিনিট পরপর ৫-১০ মিনিটের জন্য ছোট বিরতি নিন। এভাবে
চারবার পুনরাবৃত্তি করুন। তারপর একটি দীর্ঘ বিরতি নিন। বিরতিতে কিছুক্ষণ ব্যায়াম, মেডিটেশন, হালকা ঘুম
কিংবা হাঁটাহাঁটি করতে পারেন। এরকম অনেক কৌশল রয়েছে। আপনার জন্য কোনটি উপকারী তা
জানুন এবং মেনে চলুন।
পড়তে
বসার আগে বিষয়ের অগ্রাধিকার অনুযায়ী তালিকা তৈরি করুন। এতে কোনটি আগে, কোনটি পরে পড়তে
হবে সে সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে। এজন্য গুরুত্বপূর্ণ পড়ার বিষয়গুলো আগে চিহ্নিত করুন, এতে আরও
কার্যকরভাবে সময় কাজে লাগাতে পারবেন। প্রথমে কী করা উচিত সে সিদ্ধান্ত নিতে সমস্যা
হলে, আপনার
লক্ষ্য অনুযায়ী কোনটির ডেডলাইন আগে সেটি দেখুন। এভাবে ক্লাস টাস্ক থেকে
কোর্সওয়ার্ক সম্পন্ন করতে গুগল ক্যালেন্ডার, ক্লিকআপের মতো অ্যাপ সাহায্য করতে
পারে।
পড়ায়
মনোযোগ ধরে রাখতে কিছু স্মার্ট অভ্যাস এবং কৌশল মেনে চললে দ্রুত পড়া মনে থাকে।
যেমন, আলাদা
অধ্যায় বা বিষয়ের জন্য আলাদা রঙের ফ্ল্যাশকার্ড তৈরি করে নিজের ভাষায় সংক্ষেপে
তথ্য লিখে রাখা। পড়া অন্য কাউকে বুঝিয়ে দেওয়া। বড় তথ্য ছোট ছোট অংশে ভাগ করা। নির্দিষ্ট সময় পরপর পুনরায় পড়া। একই বিষয়ে ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে কী কী প্রশ্ন আসতে
পারে তা চিন্তা করা এবং তার উত্তর জানা।
নিজেকে
পুরস্কার দিন
প্রতিটি
লক্ষ্য অর্জনের পর কোনো কিছু পেলে আগ্রহ অনেকগুণ বাড়ে। তাই কিছু আনন্দ পাওয়ার আশায়
পড়ায় মনোযোগ ধরে রাখতে পারলে মন্দ কী! পুরস্কার যে সবসময় বড় হতে হবে এমন তো
কথা নেই। ছোটোখাটো উদযাপন দিয়েও আনন্দ উপভোগ করা যায়। সেটি হতে পারে আপনার প্রিয়
অনুষ্ঠানের একটি সিজন দেখা, টেক-আউট খাবারের অর্ডার দেওয়া বা বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরতে যাওয়া। তবে
আপনার লক্ষ্য অনুযায়ী কতটুকু এগিয়েছেন সেটি মাথায় রাখতে ভুলবেন না।
পড়ার সঠিক পরিবেশ তৈরি করুন
একটি শান্ত
ও আরামদায়ক পরিবেশে পড়ার অভ্যাস করুন। যেখানে আলো ও বাতাস পর্যাপ্ত, সেখানে বসে
পড়ুন। টিভি, মোবাইল
বা অন্য কোনো ধরনের বিঘ্ন থেকে নিজেকে দূরে রাখুন।
লক্ষ্য নির্ধারণ করুন
প্রতিদিন কী
পড়বেন এবং কত সময়ের মধ্যে পড়বেন, তা নির্ধারণ করুন। ছোট ছোট লক্ষ্য স্থির করুন। এই ছোট
লক্ষ্যগুলো অর্জিত হলে নিজের মধ্যে আত্মবিশ্বাস বাড়বে।
সময় পরিকল্পনা করুন
সময়
ব্যবস্থাপনা গুরুত্বপূর্ণ। একটি রুটিন তৈরি করুন এবং সেই অনুযায়ী পড়াশোনা করুন।
প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলুন।
পড়ার কৌশল পরিবর্তন করুন
একই
পদ্ধতিতে দীর্ঘ সময় পড়লে একঘেয়েমি আসতে পারে। তাই কখনো নোট তৈরি করুন, কখনো চিত্র
বা চার্ট ব্যবহার করুন। প্রয়োজনে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য রঙিন কলম দিয়ে হাইলাইট করুন।
ইতিবাচক মনোভাব রাখুন
নিজের উপর
আস্থা রাখুন। পড়ালেখায় কিছুটা চাপ অনুভূত হলে আত্মসমালোচনায় না গিয়ে ইতিবাচক
মনোভাব ধরে রাখুন।
পরিবার ও শিক্ষকের সাহায্য নিন
আপনার
মনোযোগ ধরে রাখতে যদি কোনো সমস্যা হয়, তা হলে পরিবারের সদস্য বা শিক্ষকের
সঙ্গে কথা বলুন। তাদের দিকনির্দেশনা আপনার জন্য সহায়ক হতে পারে।
প্রতিবেদনটি লিখেছেন:
লেখক, গবেষক ও স্কাউটার—মোহাম্মদ
সাইফুদ্দিন
শিক্ষক—বায়তুশ শরফ আদর্শ কামিল (অনার্স—মাস্টার্স)
মাদরাসা
মোবাইলঃ ০১৮১৯৯৪৭৩৮৭, ই-মেইলঃsaifuddinbaitushsharaf@gmail.com
No comments
Post a Comment