নিজ দেশ থেকে অন্য দেশে পড়তে যাওয়ার কৌশল
নিজ দেশ থেকে
অন্য দেশে পড়তে যাওয়ার কৌশল
বিদেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ বর্তমান প্রজন্মের জন্য একটি জনপ্রিয় ও কার্যকর পথ। এটি কেবল বৈশ্বিক মানের শিক্ষা লাভের সুযোগ দেয় না, বরং ব্যক্তিগত ও পেশাগত দক্ষতাও উন্নত করে। তবে এ যাত্রা সহজ নয়। সঠিক প্রস্তুতি ছাড়া এটি একটি জটিল এবং চাপপূর্ণ অভিজ্ঞতায় পরিণত হতে পারে। বিদেশে পড়তে গেলে কখন প্রস্তুতি নিতে হবে? স্নাতক শেষ বর্ষ থেকেই কি প্রস্তুতি নেব? নাকি আরও আগে নেওয়া উচিত? এমন প্রশ্ন আমাদের মাথায় ঘুরপাক খায়। এ ছাড়া কারও কারও সিজিপিএ হয়তো কম কিন্তু বিদেশে পড়তে যেতে চান, তাঁরা কী করবেন? আর বিদেশে পড়তে গেলে কিছু বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। এ সবকিছু নিয়েই আমাদের আজকের আয়োজন।
লক্ষ্য
নির্ধারণ করুন
আপনার
পড়ার উদ্দেশ্য কী? পেশাগত উন্নতি,
গবেষণা, বা নতুন সংস্কৃতি অভিজ্ঞতা—উদ্দেশ্য সুনির্দিষ্ট করা অত্যন্ত
গুরুত্বপূর্ণ। এরপর নির্ধারণ করুন কোন বিষয় এবং কোন দেশে পড়তে চান।
বিভিন্ন
দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর র্যাংকিং, খরচ, এবং প্রোগ্রামের মান যাচাই করুন। আপনার আগ্রহ
এবং ভবিষ্যৎ লক্ষ্য অনুযায়ী সেরা প্রোগ্রামটি বেছে নিন।
দেশের বাইরে গেলে আপনাকে
পাসপোর্ট করতেই হবে। তাড়াহুড়ো করে পাসপোর্ট তৈরি করতে গেলে যেহেতু অতিরিক্ত ফি
দিতে হয় তাই সময় থাকতেই পাসপোর্ট করে ফেলুন। এতে আরেকটি সুবিধা হবে। তা হলো,
পাসপোর্টে যদি নাম, বাবা-মায়ের নাম বা অন্য
কোনো তথ্যের ভুল বা বানান ভুল থাকে তাহলে আপনি সংশোধনের যথেষ্ট সময় পাবেন। তাই
দেরি না করে পাসপোর্ট করতে দিন। তাছাড়া পাসপোর্ট তৈরি করতে দিলে আপনি প্রবেশ করবেন
বিদেশে পড়তে যাওয়ার প্রক্রিয়ার মধ্যে। যা আপনার অ্যাকাডেমিক ও অন্যান্য প্রস্তুতি
নিতে অনুপ্রেরণা জোগাবে।
নতুন জায়গায় আপনার নামই
আপনার পরিচয়। দাপ্তরিক কাগজপত্র যেমন পাসপোর্ট, শিক্ষাগত সনদপত্র, জন্মসনদ, ড্রাইভিং
লাইসেন্স (যদি থাকে), বিভিন্ন কোর্সের সনদপত্র, ব্যাংক অ্যাকাউন্টের কাগজপত্র ইত্যাদি প্রতিটি জায়গায় আপনার নাম, আপনার বাবা-মায়ের নাম একই হওয়া গুরুত্বপূর্ণ। এক হলেই নিঃসন্দেহে প্রমাণিত
হবে যে, এই কাগজপত্রগুলো একই ব্যক্তির। এক্ষেত্রে নামের
বানান সব কাগজপত্রে একই হতে হবে। কারণ একই নামের কিন্তু ভিন্ন বানানের ভিন্ন
ব্যক্তি দেখা যায়। আপনার সর্বশেষ শিক্ষাগত যোগ্যতা পর্যন্ত সনদপত্র সংগ্রহ করতে
হবে। সে অনুযায়ী এসএসসি, এইচএসসি, স্নাতক,
স্নাতকোত্তর ইত্যাদি পর্যায়ের প্রতিটি সনদপত্র সংগ্রহ করুন। প্রতিটি
কাগজপত্র মিলিয়ে দেখুন নাম ও নামের বানান, স্থায়ী ঠিকানা
ইত্যাদি একই আছে কি না। না থাকলে তা সংশোধন করুন।
বিদেশে পড়াশোনা করতে হলে সে
দেশের বা আন্তর্জাতিক ভাষা হিসেবে ইংরেজিতে দক্ষ হওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
যেকোনো বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয় তাই পড়ার সুযোগ বা বৃত্তিপ্রদানের আগে দেখে নেয়
ওই শিক্ষার্থীর ভাষা যোগ্যতা। আইইএলটিএস (IELTS)
International English Language Testing System হচ্ছে ইংরেজি ভাষার
দক্ষতা যাচাইয়ের জন্য আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একটি পরীক্ষা। যাদের মাতৃভাষা
ইংরেজি না এই পরীক্ষা মূলত তাদের জন্য। প্রথমে যুক্তরাজ্য ও অস্ট্রেলিয়ায়
উচ্চশিক্ষার জন্য আইইএলটিএস অপরিহার্য থাকলেও বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও ইউরোপের বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয় এ পরীক্ষার স্কোর গ্রহণ করছে।
কাঙ্খিত স্কোর অর্জন করতে অনেকের বেশ সময় লেগে যায় বলে এর প্রস্তুতি বেশ আগে থেকেই
নেওয়া ভালো। ফুল ফান্ড বা ভালো ধরনের পার্শিয়াল স্কলারশিপ পেতে হলে আন্ডার-গ্র্যাজুয়েটের
শিক্ষার্থীদের জন্য SAT ও স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী জন্য GRE/
GMAT পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে হবে একটু আগে থেকে।
তালিকা করুন
বিশ্ববিদ্যালয়ের
পছন্দের দেশগুলোর কমপক্ষে
পাঁচটি করে বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকা তৈরি করুন। এই তালিকা তৈরির আগে অবশ্যই আপনি
কমপক্ষে প্রতিটি দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য নেড়েচেড়ে দেখবেন। সেখান থেকে এই
সংক্ষিপ্ত (প্রতিটি দেশের পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয়) তালিকা তৈরি করবেন। এই তালিকা
করার সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের কোর্স ফি, আবাসন খরচ, অবসরে কাজের সুবিধা, আপনার সামর্থ্যরে মধ্যে আছে কি না, আপনার
স্বাস্থ্যের অনুকূল কি না, স্থানীয় বাসিন্দারা অভিবাসীদের
প্রতি কেমন আচরণ করে ইত্যাদি বিষয়ে জানতে চেষ্টা করবেন। ভালো হয় যারা আপনার
ইতিমধ্যে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে তাদের থেকে জেনে নেওয়া। এর মধ্য থেকে যেটি আপনার
জন্য প্রযোজ্য সেগুলোর তালিকা তৈরি করবেন। বিষয় নির্ধারণের সময় খেয়াল রাখবেন
বিষয়টি যেন আপনার আগের পড়াশোনার ধারাবাহিকতা রক্ষা করে। তালিকায় স্থান পাওয়া
বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কোন সময়ে ছাত্র গ্রহণ করে লিখে রাখতে হবে। আবেদনের শেষ সময় আগে
থেকেই নোট করে রাখতে হবে।
বিদেশে
পড়ার খরচ উচ্চ হতে পারে। শিক্ষাবৃত্তি, শিক্ষাঋণ বা ব্যক্তিগত সঞ্চয়ের বিষয়ে আগে থেকেই পরিকল্পনা করুন। খরচের
মধ্যে টিউশন ফি, থাকা-খাওয়ার খরচ, এবং
ভ্রমণের খরচ যোগ করতে ভুলবেন না।
প্রয়োজনীয়
নথিপত্র প্রস্তুত করুন
আপনার
পাসপোর্ট, ভিসা, অ্যাকাডেমিক
ট্রান্সক্রিপ্ট, সুপারিশপত্র, এবং
আবেদনপত্র সঠিকভাবে প্রস্তুত করুন। এগুলো সময়মতো জমা দেওয়া অত্যন্ত জরুরি।
বিদেশে পড়ার ক্ষেত্রে
বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দিয়ে থাকে। এসব বিষয়ে খোঁজখবর পাওয়ার জন্য
বাংলাদেশে অবস্থিত সেসব দেশের দূতাবাসে খোঁজ নিতে হবে। তা ছাড়া কলেজ বা
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যারা আগে সেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গেছেন তাদের কাছ থেকে
পরামর্শ নিতে হবে এবং তারা কোন কোন পদ্ধতি অবলম্বন করেছেন তা অনুসরণ করতে হবে।
প্রয়োজনে পেশাদার পরামর্শকের সাহায্য নেওয়া যেতে পারে।
বিদেশে শুধু পড়াশোনা না,
অন্যান্য দক্ষতাও বেশ গুরুত্ব পেয়ে থাকে। উচ্চশিক্ষার জন্য সহশিক্ষা
কার্যক্রম বা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনে কাজের অভিজ্ঞতার সনদ বা পুরস্কার বেশ গুরুত্ব
বহন করে। এ ধরনের কার্যক্রমে অংশ নিয়ে সনদ অর্জন করে নিজের পোর্টফোলিও ভারী করার
সুযোগ হাতছাড়া করা ঠিক হবে না। তাছাড়া কম্পিউটারের কিছু বেসিক প্রোগ্রামিং ভাষা,
মাইক্রোসফট অফিসের বিভিন্ন প্রোগ্রামে দক্ষতা অর্জন, ড্রাইভিং শেখা, টুকটাক রান্না বা প্রাথমিক চিকিৎসার
কৌশল জেনে রাখা খুব কাজে দেবে।
আবেদন প্রক্রিয়া: বিদেশে পড়াশোনার জন্য আবেদন
প্রক্রিয়া শুরু করুন। প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট যেমন পাসপোর্ট, অ্যাকাডেমিক
ট্রান্সক্রিপ্ট, রিকমেন্ডেশন লেটার ইত্যাদি সংগ্রহ করুন।
প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের আবেদন প্রক্রিয়া ও সময়সীমা অনুযায়ী আবেদন জমা দিন।
ভিসা আবেদন: যদি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভর্তি
নিশ্চিত হয়, তাহলে ভিসা আবেদন প্রক্রিয়া শুরু করুন। নির্ধারিত ফরম পূরণ করে প্রয়োজনীয়
ডকুমেন্ট সহ ভিসার জন্য আবেদন করুন। ভিসা প্রক্রিয়া সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য
সংশ্লিষ্ট দূতাবাসের ওয়েবসাইট থেকে জেনে নিন।
বাসস্থান ও পরিবহণ: বিদেশে যাওয়ার পর যেখানে থাকবেন
সেই বাসস্থানের ব্যবস্থা করুন। বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে থাকার সুযোগ থাকলে তা
সম্পর্কে খোঁজ নিন অথবা প্রাইভেট বাসস্থান ভাড়া নিন। স্থানীয় পরিবহণ ব্যবস্থা
সম্পর্কেও পূর্বেই ধারণা নিন।
সংস্কৃতির
সঙ্গে পরিচিত হোন
যে
দেশে যাচ্ছেন, সেখানকার সংস্কৃতি,
আইনকানুন এবং পরিবেশ সম্পর্কে ধারণা নিন। এটি নতুন জায়গায় মানিয়ে
নিতে সাহায্য করবে।
বিভ্রান্ত হবেন না: আপনি যদি কনফিডেন্ট হন, কেউ আপনাকে বিভ্রান্ত করতে
পারবে না। তাই কনফিডেন্স খুবই জরুরি। একটা বিষয় মনে রাখবেন, টাকা
দিয়ে কখনো ভিসা কেনা যায় না। আপনার যোগ্যতা থাকলেই কেবল আপনি এডমিশন এবং ভিসা
পাবেন। তাই প্ররোচনায় বিভ্রান্ত হবেন না। অনেকে এডমিটেড হওয়ার পরও আত্মবিশ্বাসের
অভাবে ভিসা পেতে ব্যর্থ হন। একটা সাধারণ জ্ঞান হলো, একটা
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যদি আপনাকে ছাত্র হিসাবে গ্রহণ করে, তবে
দূতাবাস ভিসা দিতে বাধ্য; যদি না কোনো মেজর ত্রুটি থাকে। তাই
আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে অগ্রসর হোন।
বিদেশে পড়ার প্রস্তুতি একটি পরিকল্পিত এবং ধৈর্যের প্রক্রিয়া। সঠিক
পরিকল্পনা, সময়ানুবর্তিতা এবং পরিশ্রম আপনাকে স্বপ্নপূরণের পথে এগিয়ে নেবে। উপরে
বর্ণিত কৌশল ও পরামর্শগুলি অনুসরণ করে প্রস্তুতি নিলে আপনি আপনার স্বপ্নের
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার সুযোগ পেতে পারেন এবং ভবিষ্যতে একটি সফল ক্যারিয়ার গড়তে
পারেন।
প্রতিবেদনটি লিখেছেন:
লেখক, গবেষক ও স্কাউটার—মোহাম্মদ
সাইফুদ্দিন
শিক্ষক—বায়তুশ শরফ আদর্শ কামিল (অনার্স—মাস্টার্স)
মাদরাসা
No comments
Post a Comment