Header Ads

ইসলামের আলোকে মাদকাসক্তির ক্ষতিকর প্রভাব ও পরিত্রাণের উপায়

ইসলামের আলোকে মাদকাসক্তির ক্ষতিকর প্রভাব ও পরিত্রাণের উপায়


 

মাদকাসক্তি বর্তমান সমাজের এক ভয়াবহ অভিশাপ। এটি মানুষের শারীরিক, মানসিক, এবং সামাজিক জীবনে মারাত্মক ক্ষতি ডেকে আনে। ইসলাম মাদককে হারাম হিসেবে ঘোষণা করেছে এবং এর থেকে দূরে থাকার কঠোর নির্দেশনা দিয়েছে। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেছেন: “হে ঈমানদারগণ! মদ, জুয়া, প্রতিমা এবং ভাগ্য নির্ধারণকারী তীর শয়তানের অপবিত্র কাজ। সুতরাং, তোমরা তা থেকে বেঁচে থাকো, যাতে তোমরা সফল হতে পার।” (সূরা মায়িদা: ৯০)

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, “যখন কোন ব্যক্তি মাত্রাতিরিক্ত পরিমাণে কোন ড্রাগ গ্রহণ করার ফলে এমন এক অবস্থায় পৌঁছায় যা তার নিজের ও সমাজের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়, তখন তাকে মাদকাসক্তি বলে। আমাদের দেশে সাধারণত গাঁজা, ভাং, চরস, আফিম, হিরোইন, কোকেন, মদ ইত্যাদি মাদকদ্রব্য হিসেবে পরিচিত। এর সঙ্গে আরও রয়েছে তরল অ্যালকোহল শ্রেণির মদ । যেমন- রাম, ভদকা, হুইস্কি ইত্যাদি।

বাংলাদেশের মাদক পরিস্থিতি নিয়ে জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে মাদকাসক্তদের মধ্যে ৮৪ শতাংশ পুরুষ, ১৬ শতাংশ নারী। সমাজের বিত্তশালী ব্যক্তি থেকে শুরু করে নারী ও শিশু-কিশোররাও মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। ওই প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, দেশজুড়ে প্রায় সাড়ে তিন লাখ মানুষ নানাভাবে মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। এ ছাড়া মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী দেশে আসক্তদের শতকরা ৯০ ভাগকে কিশোর-তরুণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। তাদের শতকরা ৪৫ ভাগ বেকার ও ৬৫ ভাগ আন্ডারগ্র্যাজুয়েট। আর উচ্চশিক্ষিতের সংখ্যা ১৫ শতাংশ। তবে আরো বেশ কয়েকটি সংস্থার তথ্যানুযায়ী, অবৈধ মাদকদ্রব্য আমদানির জন্য প্রতিবছর ১০ হাজার কোটিরও বেশি টাকার মুদ্রা বিদেশে পাচার হচ্ছে।

বর্তমানে মাদকাসক্তদের পরিসংখ্যানের কোনো তথ্য না থাকলেও বেসরকারিভাবে দেশে প্রায় ৭৫ লাখের বেশি মাদকাসক্ত রয়েছে এবং মাদকসেবীদের মধ্যে ৮০ শতাংশই যুবক, তাদের মধ্যে ৪৩ শতাংশ বেকার। ৫০ শতাংশ অপরাধের সঙ্গে জড়িত রয়েছে। কিছুদিন আগেও যারা ফেনসিডিলে আসক্ত ছিল, তাদের বেশির ভাগই এখন ইয়াবা আসক্ত। সম্প্রতি ইয়াবা আমাদের দেশের তরুণসমাজকে গ্রাস করেছে। প্রতিদিন যেমন ইয়াবা ধরা হচ্ছে, তেমনি প্রতিদিন হাজার হাজার পিস ইয়াবা তরুণরা গ্রহণ করছে। একটি পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, মাদকসেবীরা গড়ে প্রতিদিন অন্তত ২০ কোটি টাকার মাদক সেবন করে থাকে; হিসাব অনুযায়ী মাসে ৬০০ কোটি টাকা। অন্যদিকে সারা দেশে প্রায় ৩০ লাখ মাদক কারবারি প্রতিদিন কমপক্ষে প্রায় ২০০ কোটি টাকার মাদক কেনাবেচা করে।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী একজন মাদকাসক্ত তার নেশার পেছনে প্রতিদিন সর্বোচ্চ ৫০০ থেকে সর্বনিম্ন ৫০ টাকা খরচ করে। তবে বেশির ভাগের ক্ষেত্রেই দৈনিক খরচ ১০০ থেকে ২০০ টাকার মধ্যে। পক্ষান্তরে এই নেশার টাকার জোগান দিতে আসক্তরা বেছে নেয় বিভিন্ন অন্যায় পথ। যার ফলে সৃষ্টি হচ্ছে খুন, ছিনতাই, ডাকাতির মতো ঘটনা। নেশার জন্য বাবা খুন হচ্ছে সন্তানের হাতে। সেই খুনের দায় বহন করে ছেলেটি হয় জেলে, না হয় অন্ধকার জগতে প্রবেশ করছে। এভাবে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদে মাদক মানুষকে ঠেলে দিচ্ছে অবাধ ও বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে।

এখানেই শেষ নয়, ৪০ বছর বয়সের পরে আকস্মিক মৃত্যুর ৫০ শতাংশই ঘটে মাদকাসক্তির কারণে। আর সেই লোকটি মৃত্যুর আগে রেখে যায় কিছু উত্তরসূরি। মাদকাসক্তদের ৫৯ শতাংশই আসে এমন পরিবার থেকে, যাদের মাসিক আয় এক হাজার থেকে পাঁচ হাজার টাকার মধ্যে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী মাদকাসক্তদের ৩০ শতাংশই শুধু নেশার খরচ জোগান দিতে নানা অপরাধ কর্মে জড়িয়ে পড়ে। এসব জরিপে যে তথ্যটি সবচেয়ে বেশি আতঙ্ক ও ভয়ের কারণ, তা হচ্ছে দেশে মাদকাসক্তদের ৯১ শতাংশই কিশোর তরুণ ও যুবক বয়সী। আর এই আসক্তির ভয়াবহ বিস্তার ঘটেছে ছাত্র ও শিক্ষিত বেকারদের মধ্যে।

সর্বনাশা মাদকের কারণে যুবসমাজ যে শুধু মেধাশূন্য হচ্ছে তা-ই নয়, এ মাদকাসক্তদের মধ্যে মনুষ্যত্বও লোভ পাচ্ছে। সম্প্রতি আমাদের দেশের সংবাদপত্রে প্রতিদিন যেসব খুন, সন্ত্রাস, মেয়েদের উত্ত্যক্ত করার ঘটনাসহ অপরাধের যেসব খবর ছাপা হচ্ছে, তার সব ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে দেশের তরুণ যুবসমাজ এর একটি অংশ

মাদকাসক্ত হওয়ার কারণ : মানুষ যেসব সু-নির্দিষ্ট কারণে মাদকদ্রব্য অপব্যবহার করে নেশাগ্রস্ত হয় সেগুলো হল-

১ । মাদকদ্রব্যের প্রতি কৌতুহল । ২ । বন্ধু বান্ধব ও সঙ্গীদের প্রভাব । ৩ । নতুন অভিজ্ঞতা লাভের আশা । ৪ । সহজ আনন্দ লাভের বাসনা । ৫ । মাদকদ্রব্যের সহজলভ্যতা । ৬ । নৈতিক শিক্ষার অভাব । ৭ । পারিবারিক কলহ ও অশান্তি । ৮ । বেকারত্ব, আর্থিক অনটন ও জীবনের প্রতি হতাশা । ৯ । মাদকদ্রব্যের কুফল সম্পর্কে অজ্ঞতা ।

মাদকাসক্তির ক্ষতিকর প্রভাবঃ ১. শারীরিক ক্ষতি: মাদক দীর্ঘমেয়াদে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ধ্বংস করে। এটি হৃদরোগ, লিভার সিরোসিস, এবং মানসিক রোগের কারণ হতে পারে। ২. মানসিক বিপর্যয়: মাদকাসক্ত ব্যক্তিরা হতাশা, উদ্বেগ এবং মানসিক ভারসাম্যহীনতায় ভোগে। ৩. পারিবারিক ও সামাজিক বিপর্যয়: মাদকাসক্ত ব্যক্তি পরিবার ও সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। এটি পরিবারে কলহ সৃষ্টি করে এবং সমাজে অপরাধের হার বাড়ায়। ৪. আধ্যাত্মিক ক্ষতি: মাদক একজন মুসলিমকে নামাজ, রোজা এবং অন্যান্য ইবাদত থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যায়, যা আল্লাহর নিকট প্রিয় হওয়ার পথে অন্তরায় সৃষ্টি করে।

মাদকাসক্তি থেকে পরিত্রাণের উপায়ঃ ১. ইসলামি শিক্ষার চর্চা: কোরআন ও হাদিসের শিক্ষা গ্রহণ করে এবং আল্লাহর প্রতি আস্থা রেখে মাদকের বিরুদ্ধে মনোবল তৈরি করতে হবে। ২. পরিবার ও সমাজের ভূমিকা: পরিবার ও সমাজের সহযোগিতা এবং মাদকাসক্তদের প্রতি সহানুভূতিশীল আচরণ তাদের সঠিক পথে ফেরাতে সাহায্য করতে পারে। ৩. চিকিৎসা ও পরামর্শ: প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ এবং পুনর্বাসন কেন্দ্রে ভর্তি করে চিকিৎসা করানো উচিত। ৪. সতর্কতা ও পরিবেশ সৃষ্টি: মাদকদ্রব্যের সহজলভ্যতা রোধে কঠোর আইন প্রণয়ন এবং যুব সমাজের জন্য স্বাস্থ্যকর বিনোদনের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। ৫. আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা: নিয়মিত নামাজ, কুরআন তেলাওয়াত, এবং দোয়ার মাধ্যমে আল্লাহর সাহায্য চাওয়া অত্যন্ত কার্যকর।

মাদকনির্ভরশীল ব্যক্তির চিকিৎসার সব পর্যায়ে পরিবারের অংশগ্রহণ ও সহযোগিতা প্রয়োজন। মাদকনির্ভরশীল ব্যক্তি স্বভাবতই চিকিৎসা নিতে চায় না। কারণ সে বুঝতেই পারে না যে তার চিকিৎসার প্রয়োজন। আবার অনেকেই শারীরিক যন্ত্রণার ভয়ে মাদক চিকিৎসায় অনীহা পোষণ করে। এ ক্ষেত্রে পরিবারের স্ত্রী, বাবা-মায়েদের উচিত নেশার নেতিবাচক দিক এবং জীবনের সম্ভাবনাময় বিষয়গুলো তুলে ধরে প্রতিনিয়ত সহমর্মিতামূলক আচরণের মাধ্যমে তাকে চিকিৎসা নিতে আগ্রহী করে তোলা। এমনভাবে আচরণ করতে হবে, যাতে সে বুঝতে পারে, আমরা তাকে ভালোবাসি, তার সুন্দর ও সুস্থ জীবনের জন্য আমরা সহযোগিতা করতে চাই। তবে এ ক্ষেত্রে পরিবারের ভূমিকাই সবচেয়ে বেশি। তবে সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই। আমাদের এই সচেতনতা ও সহযোগিতা যুবসমাজকে যুবশক্তিতে পরিণত করবে। মাদকাসক্তি থেকে মুক্তি পেতে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রকে একযোগে কাজ করতে হবে। ইসলামের নির্দেশনা মেনে চলা এবং সচেতনতা বৃদ্ধি করলে মাদকমুক্ত সমাজ গড়ে তোলা সম্ভব।

প্রতিবেদনটি লিখেছেন:
লেখক, গবেষক ও স্কাউটার
মোহাম্মদ সাইফুদ্দিন

শিক্ষকবায়তুশ শরফ আদর্শ কামিল (অনার্সমাস্টার্স) মাদরাসা

মোবাইলঃ ০১৮১৯৯৪৭৩৮৭,

ই-মেইলঃsaifuddinbaitushsharaf@gmail.com

 

 

 

 

No comments

Powered by Blogger.